#নীলমনি
#তোয়ামনি
নীলমনি ~২৭
আরিয়া চোখে বুজে শুয়ে রয়েছে। নিজের জীবন সম্পর্কে অবগত হয়ছে একটু আগে। ডাক্তারের কাছে জানিতে পেরেছে খুব সম্ভব সে আর নিজের পায়ে হাটতে পারবে না। কাকুলি চৌধুরী আরিয়ার পাশে বসে কাদছিলো তাই নিলয় উনাকে বাইরে নিয়ে গেছে। মৌনোতা কেভেনে ঢুকে দেখে আরিয়া শুয়ে রয়েছে। ও আরিয়ার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত পরতেই চোখ খুলে আরিয়া। ও ভেবেছে রিমন এসেছে। মৌনোতা মৃদু হাসি দিয়ে বলে
‘এখন কেমন লাগছে’?
আরিয়া মাথা নেড়ে জানাই ‘ভালো’।
‘কিছু খাবে’?
আরিয়া ডানে বামে মাথা নাড়ায়ে চোখ বুজে। মৌনোতা আরিয়ার মাথা বুলাতে বুলতে দুই ফোটা চোখের পানি ফেলে। পরপরি মুছে ফেলে।
‘আচ্ছা তুমি রেস্ট করো আমি যাই’।
‘ভাবি উনি কি এসেছিলো’?
মৌনোতা উঠে দাড়াতেই আরিয়া ওর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
‘কে রিমন ভাইয়া’?
‘হুম’।
আরিয়ার জ্ঞান ফিরিছে আজ তিনদিন। কিন্তু একবার ও রিমন দেখতে আসে নি। ওর পা হারানোর যন্ত্রণার চেয়ে এই যন্ত্রণা যেনো ওকে বেশি ভোগাচ্ছে।
‘ভাইয়া তো এখানেই থাকে। কই আসবে আবার’?
অবাক চোখে তাকায় আরিয়া। উনি কি জানে না ওর জ্ঞান ফিরিছে তাহলে কেনো ওর সাথে দেখা করতে আসে না?
‘কিইইইইইইই! কই উনি তো একবার ও আমার সাথে দেখা করতে আসলো না’?
মৌনোতা চোখ ছোট ছোট করে বলে
‘ভাইয়া আসে নাই মানে? উনি তো প্রথম দিন থেকে হস্পিটলেই থাকে’।
আরিয়া মৌনোতার কথা শুনে উঠতে যায়। মৌনোতা বাধা দেয়
‘আরে কি করছো পায়ে ব্যাথা লাগবে। উঠছো কেনো’।
আরিয়া মৌনোতার দুই হাত ধরে বলে
‘ভাবি প্লিজ আমি উনাকে একবার দেখত্র চায়। আমি উনার সাথে কথা বলতে চাই। প্লিজ ভাবি তুমি অনাকে আমার কাছে আসতে বলো। প্লিজ’।
‘আচ্ছা আচ্ছা আমি বলছি। তুমি এত হায়পার হইও না। শুয়ে পরো আমি ভাইয়া কে ডেকে আঞ্চছি’।
মৌনোতা দ্রুত পায়ে কেভেন থেকে বের হয়। রিমন বাইরে বসে ছিলো। মৌনোতা দেখতে পেয়ে রিমনের কাছে যায়।
‘ভাইয়া। (চোখ তুলে তাকায় রিমন)
আপনাকে আরিয়া খুজছে ও আপনার সাথে কথা বলতে চায়। আপনি নাকি ওর সাথে দেখা করেন নাই’।
রিমন কিছু বলে না। মাথা নিচু করে ফেলে। ওর যেনো সাহস হচ্ছে না আরিয়ার সামনে যেতে। মৌনোতা আবার ডাকে
‘ভাইয়া’।
রিমন চোখের মনি চঞ্চল করে বলে
‘হুম যাচ্ছি’।
রিমন উঠে আরিয়ার কেভিনের দিকে যায়।
আরিয়া অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো রিমনের জন্য। রিমন কেভিনে প্রবেশ করতেই আরিয়ার কালচে মায়াবী চোখ থেকে অঝরে পানি ঝরতে থাকে। আরিয়া ঠোঁট কামড়ে ফোপাতে থাকে। রিমন লম্বা করে হেসে ওর পাশে বসে। মাথায় হাত দিতেই আরিয়া লাজলজ্জা ভুলে ওকে জরিয়ে ধরে। ফোপাতে ফোপাতে বলে
‘আপনি আমার সাথে একটা বার দেখা করতে আসলেন না কেনো? তাহলে কি ধরে নেবো আমার পঙ্গুত্বের জন্য আপনার ভালোবাসা থেকে আমি বঞ্চিত হলাম?
রিমনের চোখ থেকে গাল বেয়ে দুই ফোটা পানি পরে। বিষাদ পূর্ন মুখে লম্বা এক হেসে বলে
‘দূর পাগলি ভালোবাসাতো এক ধরনের আপেক্ষিক বিষয়। এটি কারো জীবনে সর্গ সুখ বয়ে আনে, আবার কাউকে দূখের সাগরে ভাসিয়ে দেয়।
তাই উচিত অংশগ্রহণকারী উভয় এক সাথে দূঃখ কষ্ট ও সুখ ভাগাভাগি করে নেওয়া’।
রিমনের কথা শুনে কান্না থামায় আরিয়া। রিমনের বুক থেকে মুখ তুলে রিমনের মুখের দিকে তাকায়। রিমন আবারো চমৎকার হেসে আরিয়ার চোখ মুছে দেয় বলে
‘কান্না করছো কেনো? ভেবেছো তোমার এই টুকু খুদের জন্য তোমাকে ছারবো। হায়রে আমার পাগলিটা। (আরিয়ার কপালে চুমু দয়ে) তোমার সারা শরীর যদি প্যারালাইসি হয়ে অবস হয়ে যায় আমি তবু ও তোমাকে ভালবাসবো। আর এইটা তো কিছুই না। এক দম কান্না করো না। তোমার প্রতি ভালোবাসা আমার এক বিন্দু ও কমে নি। আমি তোমাকে ছারছি না’।
আরিয়া আবেগে আপ্লূত হয়ে রিমন কে জরিয়ে ধরে। ওর বুকে চোখের পানি বিসর্জন দেয়। রিমন ওকে বুক থেকে তুলে বলে
‘প্লিজ আর কেদো না। সহ্য হয় না। এই বার একটু রেস্ট করো। আর তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। বিয়ের কিন্তু আর বেশি দিন নেই’।
রিমন আরিয়া কে বিছানায় শুয়ে দিয়। কলাপে চুমু দিয়ে বলে
‘আমি এখন আসি। আর কান্না করবে না আমি এখানি আছি। ওকে’।
‘শুনুন’।
‘হুম বলো
‘আপনি কিন্তু একটু পর পর আমার কাছে আসবেন। আমি আপনাকে অনেক বেশি মিস করি’।
‘ওকে ম্যাডাম। এখন ঘুম আসেন’।
বিরষ মুখে বারান্দায় বসে রয়েছে মৌনোতা। কাকুলি চৌধুরীর কান্না থামানোর ব্যার্থ চেষ্টা করে নিলয় উপরে এসেছে। কাকুলি চৌধুরী আর শিউলি চৌধুরী নিচে। মৌনোতাকে ওই ভাবে বসে থাকতে দেখে নিলয় ওর গা ঘেসে বসে। মৌনোতা চোখ মুখ কুচকে তাকিয়ে বলে
‘কি হয়েছে’।
‘উফফফ মাথা টা খুব ধরেছে। কেউ একটু টিপে দিলে ভালো লাগতো। ইসসস ছিরেই যাচ্ছে’।
নিলয় দুই আঙুল কপালে ম্যাসাজ করতে করতে বলে।
‘খুব ব্যাথা করছে? বাসায় চলে যান তাহলে আমি এই দিকে দেখছি’।
‘একটু টিপে দিলেই তো পারো কথা বাদ দিয়ে’।
মৌনোতা বিরব্রত বোধ করতে করতে বলে
‘এ….খানে’?
নিলয় মৌনোতার কোলে মাথা রেখে বলে
‘তো হস্পিটলে বাসর সাজাই”?
মৌনোতা ভ্রুদয় কঠিন করে ফেলে। মনে মনে আওরায় অসভ্য ভিলেন।
‘দাতে দাত না চেপে মাথা টিপো। এর থেকে বেশি গরম হলে আমার আবার হাত চলবে। বুঝতে পেরেছো’।
মৌনোতা আর কোনো কথা বাড়ায় না। এই লোকটা অসভ্য। কখন আবার বন্দুক বের করে ওর মাথায় ধরে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। ও চুপ চাপ মাথা টিপা শুরু করে। আশে পাশে মানুষ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে মৌনোতা কিছুটা বিচুলিত হয়। রিমন কেভিন থেকে বাইরে বের হয়ে দেখে নিলয় আর মৌনোতাকে। মুচকি হেসে ও অন্য দিকে চলে যায়। কিছুক্ষন পর নিলয় হঠাৎ করে বলে উঠে
‘মৌনোতা’।
মৌনোতা বুক ধক করে উঠে। নিলয় ওকে কখনো মৌনোতা বলে ডাকে না। মৌনোতা যখন কোনো অন্যায় করে বা নিলয় কোনো সিরিয়াস কথা বলে ঠিক তখনই নিলয় ওকে মৌনোতা বলে ডাকে৷ মৌনোতা মৃদু কন্ঠে উত্তর দেয়
‘হুম’।
‘আমি মানুষটা কেমন’?
মৌনোতা কিছুক্ষন নিলয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকায়। ওর খুব বলতে ইচ্ছে করে অসভ্য লোক। অসভ্য এক ভিলেন। তবে কিছু বলে না।
‘কেনো’?
‘না এমনি জানিতে ইচ্ছে হলো। আমি মানুষটা কেমন হলে ঠিক তোমার মনের মত হতে পারবো। আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার হতে!!”
শেষ বাক্যটা মৌনোতার বুকে এক অদ্ভুত কাপুনি উঠায়। আমার হতে ইচ্ছে করে মানে। আমি তো অনারই আছি।
মৌনোতা আমতা আমতা করে বলে
‘আমার হতে ইচ্ছে করে মানে? আপনি তো আমারই আছেন’।
নিলয় অদ্ভুত হাসি দিয়ে বলে
‘আমি তো তোমার না হওয়ার মত করে আছি। আচ্ছা কি করলে তোমার হওয়ার মত করে থাকতে পারবো?”
মৌনোতা চুপ হয়ে যায়। লোকটা কি সব বলছে। এই ভিলেনটা কি সত্যি ওকে ভালোবাসে। নিলয় উঠে মৌনোতার কানে ফু দিয়ে বলে
‘ডোন্ট ওরি আমার হাজার কষ্ট হলেও আমি তোমাকে তোমার ভালোবাসার কাছে ফিরিয়ে দিবো। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কেমন যন্ত্রণা হয় সেটা আমি বুঝি’।
নিলয় আর কিছু বলে না। উঠে চলে যায়। মৌনোতা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও বুঝতে পারে না লোকটাকে। নিশ্চয়ই কোনো প্লান করছে। অসভ্য লোক।
‘ও যেমনই হক ও তোমাকে সত্যি ভালোবাসে’।
মৌনোতা পেছন ঘুরে দেখে রিমন দাঁড়িয়ে আছে। মৌনোতা মাথা নিচু করে। রিমন ওর পাশে বসে বলে
‘তুমি ওকে যেমন ভাবো ও তার চেয়ে ও ভয়ংকর। আর সেই হিংস্রতার চেয়ে ও আরো শত গুন ভয়ংকর ভাবে ও তোমাকে ভালোবাসে’!!
মৌনোতা অবাক চোখে তাকায় রিমনের দিকে। তবে কিছু বলে না। ও জানে লোকটা ভয়ংকর। অনেক বেশি অসভ্য। কিন্তু এর থেকে শত গুন ভয়ংকর ভাবে ভালোবাসে মানে!!
রহিমা বেগম পাগলের মত হয়ে আসে। সে বাড়ি থেকে ভেবে এসেছে এই পঙ্গু মেয়ের সাথে কিছুতেই তার ছেলের বিয়ে দিবে না। অসম্ভব। সে ছুটে এসে রিমনের হাত ধরে। মৌনোতা রিমন এক সাথে চমকে উঠে। উনার পেছন পেছন রাকা হাজার বার মানা করতে করতে আসে আম্মু এমনটা কর না।
‘কি হয়েছে আম্মু এমন করছো কেনো’?
‘তুই এখনি বাড়ি চল। আমি তোর সাথে কিছুতেই এই মেয়ের বিয়ে দিমু না। এই ল্যাংরা মেয়া আমি কিছুতেই ঘরে উঠামু না। তুই এখনি যাবি আমার সাথে’।
‘আম্মু তুমি শান্ত হও কি বলছো এই সব তোমার মাথা ঠিক আছে তো। ওর সাথে আমার এংগ্রেস্মেন্ট হয়ে গেছে আর তুমি কিনা এখন এই সব বাজে কথা বলছো’।
কাকুলি চৌধুরী উপরে এসে দেখে রহিমা বেগম এসেছে। সে ছুটে এসে বলে
‘কি হিয়েছে? আপা আপনি এই সব কি বলছেন’?
‘আমি আমার ছেলেকে আপনার মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো না। ও তো ল্যাংরা ও আমার বাড়ি গিয়ে কোনো কাজ করতে পারবো না। আমি ওকে আমার বউ করুম না’।
ফুপিয়ে উঠে কাকুলি চৌধুরী। মৌনোতা শিউলি ওনাকে ধরে দূরে নিয়ে যায়। নিলয় মনোযোগী শ্রোতার মত সব শুনসে।
‘আম্মু বাযে কথা বলো না। ও আমার স্ত্রি। আমি ওকে কথা দিয়েছে’।
‘বিয়েটা তো আর হয়নি। কবুল এখনো বলা বাকি আছে। তুই চল তারাতাড়ি’।
রহিমা বেগম রিমনের হাত টেনে নিয়ে যায়। রিমন বাধা দেয়।
‘আম্মু এমন কর না বোঝার চেষ্টা করো’।
‘আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না। তুই চল’।
‘আম্মু..। তুমি কি চাও না তোমার ছেলে ভালো থাকুক। তাহলে কেনো এমন করছো’?
রহিমা ছেলেকে আগা গোরা পরখ করে বলে
‘তুই ওই ল্যংরা মেয়ের লগে ভালো থাকবি’?
‘আম্মু বাজে কথা বলো না। ও পায়ে আঘাত পেয়েছে তাই তুমি ওকে ল্যাংরা বলতে পারো না। আর আমি ওকে ভালোবাসি’।
রহিমা বেগম রিমনের হাত ছেড়ে দেয়। শান্ত কন্ঠে বলে
‘যাবি না’?
রিমন বলে
‘না’
‘ যাবি না ‘?
‘না’।
‘যাবি না’?
‘না আম্মু। তুমি শোনো….
‘আচ্ছা তর যা খুশি তাই কর। আমি তর কেউ না। আজ থেকে তর মা মৃত। আমাকে আর কখনো মা বলে ডাকবি না’।
যেভাবে ছুটে এসেছিলো সে সেই ভাবেই চলে যায়। রাকা ভায়ের কাছে এসে বলে
‘ভাইয়া তুমি মায়ের কথা শুনো না। তুমি ভাবি কে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না। আমি মাকে বুঝাবো’।
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে বসে পরে রিমন। কেনো ভ্যাগ এমন পরিহাস করছে। ভ্যাগ যেমন ই করুক সে তার সিন্ধান্তে অটল। আরিয়া যেমনই হক। সবার ঊর্ধ্বে ও আরিয়া কে ভালবাসে। আরিয়ার কোনো সমস্যাই ওর কাছে বাধ্য হয়ে দাঁড়াবে না। মাকে কোনো ও ঠিক বুঝিয়ে নিবে। ও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিলয় ওর পাশে বসে বলে
‘কি সিদ্ধান্ত নিলি তাহলে’?
‘কাজি ডাক। বিয়ে আজই হবে’।
চলবে
®তোয়ামনি
[কপি করা সম্পুর্ন নিষেধ ]