#নীলমনি
#তোয়ামনি
[কপি করা নিষেধ ]
নীলমনি ~১৪+১৫+১৬
মৌনোতা আরিয়ার রুমের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজা ভেরানো ছিলো। তাই ও হালকা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। আরিয়া রুমের কোথাও নেই। মৌনোতা কিঞ্চিৎ অবাক হয়। আরিয়া তো মাত্রই রুমে আসলো। এখনি আবার কোথায় গেলো। ও এদিক ওদিক তাকায়ে আরিয়া কে খুজতে থাকে। হয়তো ওয়াসরুমে গেছে। মৌনোতা আয়নার সামনে দাড়াতেই বেল্কনি থেকে কারো গোঙানির আওয়াজ পায়। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে সেই দিকে তাকায়। কেউ অস্বাভাবিক ভাবে গোঙাছে। ও ধীর পায়ে হেটে বেল্কনির দিকে যায়। শান্ত কন্ঠে ডাকে
‘আরিয়া’।
কিন্তু কেউ সারা দেয় না। ও আবারো ডাকে
‘আরিয়া। তুমি কি বারান্দায়’?
মৌনোতা ধীর পায়ে হেটে বেল্কনিতে যায়। দেখে খোলা চুলে এক মেয়ে বসে ফোপাছে। ও কাছে এসে কাধে হাত রেখে বলে
‘আরিয়া’।
আরিয়া মাথা তুলে তাকায়। ফোপাতে ফোপাতে বলে
‘ভাবি। ভাবি আমার পায়ে কাচ ঢুকে গেছে’।
মৌনোতা ওর পায়ের দিকে তাকায়। একটা কাচের গ্লাস ভেঙে আছে। রক্তের বন্যা হয়ে গেছে জায়গা। অনিবরত রক্ত বের হচ্ছে৷ মৌনোতা তারাতাড়ি করে আরিয়ার পায়ের কাছে বসে পরে। আরিয়া কান্না করে যাচ্ছে। যত রক্ত পরেছে মনে হয় কাচ অনেকখানি ঢুকে আছে। মৌনোতা টেনে বের করতে যায়। আরিয়া চিৎকার করে উঠে। কাচ টান দিতে গিয়ে মৌনোতার হাত ও কেটে যায়। ও মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। সাথে সাথে রক্ত বের হতে থাকে। আরিয়া ভেজা কন্ঠে বলে
‘ভাবি আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে’।
‘দাড়াও একটু কষ্ট কর’।
আরিয়া কান্না করে যাচ্ছে। এই দিকে রক্ত পরা বন্ধই হচ্ছে না। মৌনোতা হাজার চেষ্টা করেও কাচ বের করতে পারে না। ওল্টে ওর হাত আরো যখম হয়। আরিয়ার কান্না আর ও বারে। মৌনোতা আরিয়া কে বলে
‘দাড়াও আমি আন্টিকে ডাকছি’।
মৌনোতা উঠে কাকুলির ঘরে যাওয়ার জন্য। ও এক ছুটে বের হয়। কাকুলি ড্রইংরুমে বসা ছিলো। ও উপর থেকে ডাকে।
‘আন্টি। এইদকে আসেন। আরিয়ার পা কেটে গেছে। তারাতাড়ি আসেন’।
কাকুলি মৌনোতার ডাকে উপর দিকে তাকায়। কাকুলির সাথে শেফালি আর ওনার বোন ডালিয়া ছিলো।ছেলের বউ আন্টি বলে ডাকলো ব্যাপার টা কেমন। ডালিয়া বলে
‘আপা তোরে তোর ছেলের বউ আন্টি বলে’?
‘চল আগে উপরে। আরিয়ার পা আবার কি ভাবে কাটলো’।
ওনারা এক সাথে উপরে যায়। মৌনোতা আবার ও আরিয়ার কাছে যায়। ওকে শান্ত না দেয়।
আরিয়া কে হসপিটালে আনা হয়েছে। সাথে শিউলি কাকুলি আর ডালিয়া এসেছে। রোহান আর হিয়া কে মৌনোতার কাছে রেখে এসেছে। সামান্য কাচ যে এত যখম করতে পারে কেউ বুঝতে পারে নি। অপারেশনের মাধ্যামে কাচ বের করা হয়েছে। আরিয়া শুয়ে রয়েছে বেডে। পাশে কাকুলি বসে রয়েছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আজই বাসায় এসে পরবে।
মৌনোতা রোহান হিয়া কে খাইয়ে ওদের রুমে ঘুম পারিয়েছে। সাহেরা খাতুন কে ও খাবার দিয়ে ঔষধ খাইয়েছে। বাচ্চু চৌধুরী এখনো বাসায় ফেরি নি। মৌনোতার হাতে ব্যান্ডেজ করেছে। বৃদ্ধা আঙুল সহ্য হাতের তালু কেটেছে। তাই ও খেতে পারছে না। অনন্যা খেয়ে ওর রুমে চলে গেছে। বুলবুলিকে বলেছে খেয়ে নিতে।
ও রুমে আসতেই দেখে নিলয় গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুচছে। ও নিলয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাস্যা করে
‘কখন আসছেন আপনি’?
নিলয় পেছনে না ফিরেই বলে
‘কিছুক্ষন আগে’।
‘আরিয়া পায়ে ব্যাথা পেয়েছে’।
নিলয় পেছন ফিরে বলে
‘কি ভাবে’?
‘পায়ে কাচ ঢুকেছে। কাচ বের করতে না পারায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অপারেশনের মাধ্যমে বার করা হয়েছে। আজই হইতো ফিরবে’।
‘ওর সাথে কে’?
‘আন্টি আপনার চাচি আর খালা’।
নিলয় ফোন নিয়ে কাকুলি কে কল করে।
‘আপনি কি এখন খাবেন’?
নিলয় অবাক চোখে তাকায়। বাববা এই মেয়ে আবার খাওয়ার কথা বলছে। নিলয় ফোন কানে নিয়ে বলে
‘একটু পর’।
মৌনোতা আর কিছু বলে না। চুপ চাপ বিছানায় এসে শুয়ে পরে। হাতে মৃদু ব্যাথা করছে। নিলয় ফোন কানে নিয়ে বেল্কনিতে যায়। কাকুলি ওকে জানায় কাল সকালে আসবে। ও কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস ওর সারা শরীরে এসে লাগে। কি সুন্দর ওই রাতের আকাশ। তার থেকে ও বেশি সুন্দর মৌনোতা। মেয়েটা কে কি সত্যি ও ভালোবাসে নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কারন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ও জানে না কি করবে। তবে ও বেচে থাকতে মেয়ে টাকে কিছু হতে দিবে না।
ও রুমে আসতেই দেখে মৌনোতা ঘুমিয়ে পরেছে। ওর হাতে ব্যান্ডেজ। নিলয় ভ্রু বাকায় এই মেয়ে হাত কাটলো কি ভাবে। ও নিচে গিয়ে বুলবুলি কে ডাকে জিগাস্যা করে মৌনোতার হাত কেটেছে কিভাবে। বুলবুলি সব বলে। আরো বলে ও খাইনি। নিলয় খাবার বেরে দিতে বলে। বুলবুলি তারতাড়ি খাবার বেরে নিয়ে আসে। নিলয় তা নিয়ে ওর রুমে আসে।
নিলয় হাতের প্লেট টেবিলে রেখে মৌনোতার পাশে গিয়ে বসে। স্নিগ্ধ মুখ খানা দেখে। হাত টা ছুয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছে করছে একটা চুমু দিতে। কিন্তু সেই অধিকার তার নেই। আইনি ভাবে আছে কিন্তু এই মেয়ে জানলে তাকে শুট করবে। ও মৃদু স্বরে ডাকে
‘মনি। মনিমালা।
মৌনোতা শুনে নি। ও আবারো ডাকে
‘মনি…..’
মৌনোতা ঘুম ঘুম চোখে তাকায়। পাশে নিলয় কে দেখে ভয় পায়। তারারুরা করে উঠতে গিয়ে হাতে চাপ পরে।
‘আ আ আ আ বলে আর্তনাদ করে উঠে।
সঙ্গে সঙ্গে নিলয় ধরে ফেলে ওর বাহু।
‘কি করছো। ব্যাথা পেলেতো।
মৌনোতা ঝামটা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। হাত ঝারতে ঝারতে বলে
‘ছোবেন না আপনি আমাকে। আমার কিছু হয় নি’
নিলয় মুচকি হেসে বলে
‘ভয় পেয়েনো না। আমি কিছু করতে আসি নি। তুমি যতদিন না চাইবে আমি তোমাকে ভুলে ও ছুবোনা’।
মৌনোতা মুখ বাকিয়ে বলে
‘আমি কোনো দিন চাইবো না আপনি আমার কাছে আসেন’।
‘হাতে ব্যাথা পেয়েছো কি ভাবে’?
‘আপনার এত জানতে হবে না’।
নিলয় আর কথা না বাড়িয়ে খাবারের প্লেট নিয়ে আসে। মৌনোতার সামনে বসে। ভাত নিয়ে মৌনোতার মুখের কাছে নিয়ে বলে
‘নেও হা করো’।
‘আপনাকে কি বলেছি আমি খাবো’?
‘বলতে হবে কেনো? আমার বউ টা অসুস্থ। আর একজন স্বামী হিসেবে এইটা আমার দ্বায়িত্ব। নিউ হা করো
‘আপনি এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা জানেন কি ভাবে’?
‘তোমাকে এক দিন শিখিয়ে দিবো। এখন হা করো’।
‘আপনি কেনো আমার পেছনে পরেছেন? কেনো সব বিষয়ে আমার সাথে জোর দেখান’।
নিলয় ডানে বামে মাথা কাত করে বলে
‘তোমাকে আমি মুক্তি দিবো। কয়েক টা দিন সহ্য করো। আমি তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। কথা দিলাম’।
মৌনোতা শান্ত চোখ মেলে তাকায়।
‘সত্যি!
নিলয় মাথা নারায়।
‘তত দিন আমার কথা মত চলতে হবে। যখন যা করতে বলবো তখন সেটা করবে। সময় হলে আমি নিজে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো। তার পর তোমার ভালোবাসার মানুষের কাছে দিয়ে আসবো। আর আমার কথা না শুনলে একটা শুট করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিবো। এখন হা করো’।
মৌনোতা চোখ নামিয়ে ফেলে। ভালোবাসার কারনে না অন্য কনো কারনে ওকে বিয়ে করেছে। ও আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার মাঝে বলে
‘আপনি খাবেন না’?
‘হুম পরে’।
‘এখান থেকেই খান না। পরে আবার কখন খাবেন’?
‘তোমার শেষ হক তার পর খাবো’।
নিলয় মৌনীতার দিকে তাকাতেই মৌনীতা চোখ নামিয়ে ফেলে। নিশ্চয়ই এখন বন্দুক নিয়ে ওর মাথায় ধরবে। ও চুপ চাপ ভাত চিবাতে থাকে। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও সব গুলো ভাত খায়। ওর খাওয়া শেষ হলে নিলয় বেসিং এ যাই হাত ধুতে। মৌনোতা উঠে তারাতাড়ি করে নিচে যায়। বুলবুলি খেয়ে শুয়ে ছিলো। ও ওকে ডেকে উঠিয়ে আরেক প্লেট ভাত নিয়ে আসে। নিলয় রুমে এসে দেখে মৌনোতা নেয়। মেয়েটা আবার কোথায় গেলো। কিচ্ছুক্ষন পর মৌনোতা রুমে আসে।
‘খেয়ে নিন’।
নিলয় পেছন ফিরে দেখে মৌনীতা প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ও ওর কাছে গিয়ে বলে
‘তুমি কেনো আনতে গেলে আমি তো নিচে গিয়ে খেতে পারতাম’।
‘ আন্টি বাসায় নেই আর আমার হাত কাটা আপনাকে কে বেরে দিতো। তাই নিয়ে আসলাম। খেয়ে নেন’।
মৌনোতা প্লেট নিলয়ের হাতে দিয় গ্লাসে পানি ঠেলতে গেলে নিলয় এসে বাধা দেয়।
‘হাতে ব্যাথা পাবে। আমি দিচ্ছি’।
নিলয় পানি ঠেলে দেয়। মৌনোতা খেয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। নিলয় আর কথা না বাড়িয়ে খাবার খেতে বসে।
‘প্লেট এখানে রাইখেন সকালে বুলবুলি নিয়ে যাবে’।
নিলয় খেয়ে হাত ধুরে আসে। ফোন হাতে নিতেই দেখে সারা কল দিছিলো সাইলেন্ট থাকার কারনে সে তা শুনতে পাই নি। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকায়। ফোন রাখতেই আবারো বেজে উঠে। বিরক্ত বোধ করলেও নিলয় ফোনটা রিসিভ।
‘তোমার বউ কে বাচতে দিবো না আমি। তুমি আমাকে ঠকিয়েছো এর প্রতিশোধ আমি নেবোই’।
আর চোখে মৌনোতাকে দেখে। লাইটের আলো ওর মুখে পরছে। ও লাইট অফ করতে যায়। লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে। তার পর সোফায় অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসে।
‘হ্যালো।
‘হুম’।
‘কথা বলছো না কেনো? তুমি আমাকে চেনো না নিল।
নিলয় ডানে বামে মাথা কাত করে বলে
‘এত রাতে নতুন কাপালের কাছে কল দিতে লজ্জা লাগে না? কাল আমাদের বিয়ে হলো। আর আজ তুমি এতো রাতে কল দিতে আমাকে বিরক্ত করছো। নাকি আজ কাই কে পটাতে পার নি’?
‘নীল’।
ধমকে উঠে সারা।
‘হ্যালো। হ্যালো’।
নিলয় কল রেখে দেয়েছে। সারা ক্রধে ফেটে পরে। দাতে দাত কিরমির করতে থাকে। ও ফোন স্কান করে কারো নাম্বার ডায়াল করে।
‘হ্যা ম্যাডাম’।
‘কাজ কি হয়েছে’?
‘না ম্যাডান আপনি যার ছবি পাঠিয়েছেন এমন কোনো মেয়ে এখানে আসে নি’।
‘মানে’।
‘জী ম্যাডাম।
‘আচ্ছা আমি দেখছি’।
সারা ওর ভাইকে কল করে। দুই একবার বাজতেই কল রিসিভ করে।
‘হ্যালো মাসুম’?
‘হ্যা আপু। পিক গুলা রেডি। পোস্ট করবো’?
‘না। তুই কই’?
‘ক্লাবে আছি’।
‘ওকে বাসায় আয়। কিছু কথা আছে’।
‘ওকে’।
সারা অট্টহাসি দিয়ে বলে
‘তোমাদের কাউকে বাচতে দিবো না নিল আমাকে ঠকিয়েছো। এর জন্য চরম মাশুল দিতে হবে।
কাম ডাউন স্টার্ট বেবি’।
মৌনোতা আরিয়ার কাছে বসে রয়েছে। সকালে আনা হয়েছে আরিয়া কে। এতক্ষন অনন্যা ও ছিলো। মৌনোতা আরিয়া কে জিজ্ঞাসা করে
‘তুমি পা টা কাটলে কিভাবে’?
আরিয়া কি যেনো ভাবছিলো। মৌনোতার দিকে তাকিয়ে বলে
‘কি বলেন’?
‘বলেছি পা টা কাটলে কিভাবে? ওই খানে যে গ্লাস্টা ছিলো দেখো নাই’?
আরিয়া মাথা নাড়ায়।
‘জানিনা কে যেনো গ্লাসটা রেখেছিলো। আমি উড়না আনতে বেল্কনিতে গেছিলাম তখন পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙে গেছে। লাইট অন না করায় কাচে পা দিয়ে লেগে গেয়েছিলো’।
মৌনোতার মনে পরে পশুদিন তো ও শরবত খেয়ে রেখেছিলো। ইসসস ওর ভুলের জন্য মেয়েটার পা টা কেটে গেলো। যদি গ্লাস টা সরিয়ে রাখতো তাহলে আজ মেয়েটার এত কষ্ট হতো না। কাকুলি চৌধুরী আরিয়ার খাবার নিয়ে আসে।
‘তুমি গিয়ে খেয়ে নেও মা’।
মৌনোতা মিষ্টি করে হেসে বলে
‘ঠিক আছে আন্টি’।
আন্টি কথাটা শুনে কাকুলি বিরক্ত হয়। ছেলের বউ কিনা শাশুরি কে আন্টি বলে ডাকে। মৌনোতা উঠে দাড়াতেই কাকুলি চৌধুরী বলে
‘এই অসভ্য মেয়ে একটা দিবো।
মৌনোতা ঘুরে তাকায়।
‘আন্টি কি হুম। আরিয়া নিলয় আমাকে আম্মু বলে ডাকে তুমি কেনো আন্টি ডাকো’।
মৌনোতা অপরাধী স্বরে বলে
‘সরি আন্টি। আসলে কখনো কাউকে মা বলে ডাকি নি তো তাই অভ্যাস টা নেই’।
কথাটা শুনে কাকুলি চৌধুরীর খারাপ লাগে। উনি প্লেট বিছানায় রেখে এসে মৌনোতার দুই বাহু চেপে ধরে।
‘কে বলেছে তোমার মা নেই। আমি তো তোমার মা। এখন থেকে অভ্যাস করে ফেলবে। আর যেনো না শুনি আন্টি ডাক’।
মৌনোতা ছলছল চোখে তাকায়। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
‘একবার ডাকো’।
মৌনোতা ভেজা কন্ঠে বলে
‘মা’।
কাকুলি চৌধুরীর বুক ভরে যায়। মৌনোতা ওনাকে জরিয়ে ধরে কেদে দেয়।
‘একি কানদছো কেনো’?
মৌনোতা কান্নামিশিত কন্ঠে বলে
‘কখনো কাউকে মা বলে ডাকিনি। এই একটা শব্দ উচ্চারনের জন্য আল্লাহর কাছে কত কান্নাকাটি করতাম কেনো আমার মাকে সে আগে নিয়ে গিয়েছে। আর আজ সে আবারো আমাকে এক নতুন মা দিলো’।
কাকুলি মুচকি হেসে বলে
‘আল্লাহ কাছে মন থেকে চাইলে সব পাওয়া যায়। তুমি মন থেকে চেয়েছো বলে পেয়েছো। আর কান্না কাটি না। যাও এই বার খেয়ে নেও ঠিক আছে’।
মৌনোতা মাথা নাড়ায়।
বেল্কনিতে বসে মৌনোতা সূর্যাস্ত দেখছে। কি অপরুপ এই দৃশ্য। মাঝে মাঝে অনিমা আর ও এক সাথে দেখতো। অনিমার কথা মনে পরতেই মনটা বিষন্নতায় ভরে গেলো।
এই রকম এক বিকেলে ছাদে বসে মৌনোতা গান গাচ্ছিলো। হোস্টেল থেকে অনেক দিন পর বাড়ি ফিরেছিলো। তখন ইসরাকের সাথে ওর প্রথম পরিচয়। পূজার জন্য কলেজ অফ ছিল। পেছন থেকে অনিমা এসে বলেছিল
‘কিরে কে আমার বোনের মনে এত প্রেম জগালাও’।
ঘার ঘুরিতে মৌনোতা বলেছিলো
‘ধুর। এমনি গাছিলাম। আয় বস’।
‘না আগে বল কার জন্য এতো সুন্দর গান গাচ্ছিলি’।
‘কোনোএক দিন বলবো’।
‘সত্যি আমার বোনের মনে তাহলে ঢুকেছে। বাহ বাহ বাহ। বিয়েতা তবে এইবার হচ্ছে’।
অনিমা খুশিতে হাত তালি দিয়েছিলো। তখন মৌনোতা ওর কান টেনে বলেছিলো
‘চুপ। বেশি পাকামি করছিছ’।
‘আমার একমাত্র বোনের রাজকুমার বলে কথা একটু তো আনন্দ করবোই’।
তার পর ও মৌনোতাকে জরিয়ে ধরে ছিলো। পেছন থেকে মিনু বলেছিলো
‘কিরে সন্ধ্যা হলো রুমে চল। আজান দিবে তো’।
‘তুমি যাও আমরা আসছি’।
‘না এখনি চল’।
অনিমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ওর ফোনটা তো হারিয়ে গেছে কি ভাবে বলবে। কবে হবে ওদের দেখা। মৌনোতার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে।
গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকে নিলয়। কাদের ব্যাগটা আলমারিতে রাখে। নিচে মৌনোতাকে দেখে নি। ভেবে ছিলো রুমে। রুমে না দেখতে পেয়ে ভাবলো মনে হয় আরিয়ার রুমে। ও টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গোসল করে আয়নায় চুল মুছতে মুছতে দেখে মৌনোতা বিষন্ন হয়ে বেল্কনিতে বসে রয়েছে। ও ভ্রু বাকায়। ও তো সকালে বললো কিছু দিন ম্যানাজ করতে এখন আবার কান্না করছে । চুল মুছে টিশার্ট পরে বেল্কনিতে যায়৷ মৌনোতার পাশে বসে খুক খুক করে কেশে উঠে।
‘মনিমালা……….’।
লম্বা করে ডাকে। মৌনোতা ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে
‘কখন এসেছেন’?
‘এইতো একটু আগে। সকালে তো বলাম আমি তোমাকে নিয়ে যাবো তার কাছে তাহলে এখন মন খারাপ করে বসে রয়েছো কেন’?
মৌনোতা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে
‘আমার বোনের কথা অনেক মনে পরছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে’।
‘নাম্বার জানা আছে’?
মৌনোতা মাথা নাড়ায়। নিলয় ওর ফোন বের করে দেয়
‘নেও কথা বলো’।
মৌনোতার মুখে খুশি উপচে পরে। ও কল্পনা তে ও ভাবি নি নিলয় ওকে ফোন দিবে। ও ফোন নিতে গেলে নিলয় বলে
”তুমি কোথায় আছ এটা বলবে না। শুধু কেমন আছে সেটা জানবে। বারতি কোনো কথা বলে তো বুঝোই’।
নিলয় ডানে বামে মাথা কাত করে। মৌনোতা বুঝেছে নিশ্চয়ই শুট করবে। ও ডান দিকে মাথা নাড়ায়।
‘আপনার সামনেই কথা বলছি। সমস্যা নেই’।
মৌনোতা অনিমার নাম্বার ডায়াল করে। ওর হাত পা কাপছে। কত দিন পর বোনোটার সাথে কথা হবে। ও তারাতাড়ি কল করে। খুশিতে ওর কান্না আসছে। কলটা ঢুকার আগেই কেটে যায়। মনে হয় নেট প্রব্লেম। ও আবারো ট্রায় করে। কিন্তু অনিমার ফোন ওফ। ও আরো দুই তিনবার ট্রায় করে কিন্তু আশাস্বরুপ কোনো উত্তর পায় না। ওর মন আবারো খারাপ হয়ে যায়। নিলয়ের কাছে ফোন দিয়ে দেয়।
‘সইচটপ বলছে’।
নিলয় দুই চোখ ভরে মৌনোতা কে দেখে। নিষ্পাপ একটা মুখ। নিলয়ের কাছে মৌনোতা এতই সুন্দর যে ওকে দেখতে দেখতে ও কখনো বিরক্ত হবে না। মেয়েটার মন খারাপ হয়ে আছে। স্বামী হিসেবে তার তো একটা দ্বায়িত্ব আছে। এই ভাবে বউয়ের মন খারাপ দেখতে কার ভালো লাগে। ও ফোন টেবিলের উপর রেখে বলে
‘মনিমালা গান শুনবে’?
মৌনোতা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
‘কে শোনাবে’?
‘কেনো আমি’।
‘সত্যি’!
নিলয় মাথা নাড়ায়।
‘ওয়েট’।
নিলয় রুমে চলে যায়।
নিলয় রুম থেকে ওর গিটার নিয়ে আসে। মৌনোতা অবাক দৃষ্টিতে দেখে।
‘আপনার গিটার আছে’?
নিলয় সুর তুলতে তুলতে বলে
‘হুম’।
মৌনোতার দিকে তাকিয়ে বলে
‘বউর মন খারাপ দেখতে কার ভালো লাগে বলো’।
মৌনোতা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে৷ এই প্রথম নিলয়ের কথা ওর বিরক্ত লাগছে না। নিলয় মৌনোতার দিকে দৃষ্টি স্থির করে। একটু মিউজিক দেয়। তার পর গান শুরু করে
“তোমায় দেখতে দেখতে আমি
যেনো অন্ধ হয়ে যাই
দুনিয়াতে তুমি ছাড়া
কিছু দেখার তো আর নাই…..!
আবারো একটু মিউজিক দেয়। মৌনোতা ধীরে ধীরে নিলয়ের দিকে তাকায়। নিলয় ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর দৃষ্টিতে দৃষ্টি পরতেই কেপে উঠে মৌনোতার হ্রদ স্পন্দন। নিলয়ের বলা প্রতিটা শব্দ মৌনোতার শরীরে শিহরন বয়ে নিয়ে যায়। নিলয় মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে আবার পরের কলি শুরু করে।
“তোমায় দেখতে দেখতে আমি
যেনো অন্ধ হয়ে যাই।
দুনিয়াতে তুমি ছাড়া
কিছু দেখার তো আর নাই….!
তোমার ভালোবাসা ছাড়া
এমন কিছুই আর চায়না….!
(নিলয় চোখ খুলে।)
“আমার রিদয় একটা আয়না
এই আয়নায় তোমার মুখটি ছাড়া
কিছুই দেখা যাইনা”
হো ও ও ও হুম হুম হুম……”
শেষ এইবাবে সুর দেয়। মৌনোতা অবাক হয়ে শুধু দেখছে নিলয় কে। ওর মনে কিছু একটা ছুটে চলছে। নিলয় গান শেষ করে মৌনোতা কে জিজ্ঞাসা করে
‘কেমন লাগলো’?
মৌনোতা মিষ্টি করে হেসে বলে
‘অসাধারন!
অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে মৌনোতা। কি এক মুগ্ধতা কাজ করে ওর মাঝে। নিলয় বলে
‘এটা আমার হবি। গান খুব পছন্দ। আমার ব্যান্ড ও আছে। মাঝে মাঝে শো করতে যাই বিভিন্ন প্রগরামে। আব্বুর সাথে এইটা নিয়ে ঝগড়া বাধে। আব্বু চাই আমি সিঙ্গাপুর যায়। ওই খানে বিজনেস করি বাট আমার ভালো লাগে না’।
মৌনোতা এক দৃষ্টিতে নিলয় কে দেখছে।
‘আব্বুর এক ফ্রেন্ড আছে তার মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলো। তাকে বিয়ে করি নি বলে সেটা নিয়ে ও আমার সাথে কথা বলে না। মেয়েটাকে অবশ্য আমি দেখেছিলাম আব্বু পিক পাঠাইছিল। তবে অনেক দেড়ি হয়ে গেছে’।
নিলয় মৌনোতার দিকে তাকাতেই দেখে মৌনোতা এক মনে ওকে দেখছে। ও হাত নাড়িয়ে মৌনোতার ধ্যান ভাঙে।
‘কি দেখছো’?
মৌনোতা মাথা নিচা করে বলে
‘কিছুন না। আপনার গানের গলা অসাধারণ। আল্লাহ নিজের হাতে বানিয়েছে’।
‘থ্যাংকস। খাবার খাইছো’?
মৌনোতা ডানে বামে মাথা নাড়ায়। নিলয় উঠতে উঠতে বলে
‘চলো তাহলে খেয়ে আসি। রাত তো অনেক হয়ইছে’।
নিলয় উঠে চলে যায়। মৌনোতা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পর আপন মনে গুন গুন করে উঠে
“আমার রিদয় একটা আয়না
সেই আয়ানায় তোমার মুখটি
ছাড়া কিছুই দেখা যাইনা”
(এই লাইন গুলা গুন গুন করে সুর তোলে)
বেল্কনিতে দাঁড়িয়ে সকালের সূর্য দেখছে মৌনোতা। আর এক মনে গুন গুন করছে। ভিলেনটা সারাক্ষন গুন গুন করে। আর ও সেটা মনযোগী শ্রতার মত মুখস্থ করে। কি সুন্দর কন্ঠ। ভালো লাগে ওর ভিলেনটার গান শুনতে। রুমে কিছুর শব্দ শুনে ও সেই দিকে তাকায়। দেখে নিলয় রেডি হচ্ছে। ও রুমে ঢুকে বলে
‘আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন’?
‘হুম’।
‘কোথায়?
‘একটা শো আছে। ফিরতে রাত হবে’।
‘আচ্ছা সাবধানে যাইয়েন। কিছু খেয়ে যাবেন না? আপনি দারান আমি কিছু নিয়ে আসছি।
মৌনোতা যেতে চাইলে নিলয় বাধ দেয়।
‘দেড়ি হয় যাবে। আমি কিছু খেয়ে নেবো।
ওকে। আল্লাহ হাফেজ’।
মৌনোতা মাথা নাড়ায়।
নিলয় ওকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে যায়। মৌনোতা আর কিছু বলে না। বিছানা গুছায়ে থাকে। বিছানা গোছানো শেষ হলে রুম ঝাড়ু দিয়ে বাইরে বের হয়। কাকুলি ড্রইংরুমে বসে চা খাচ্ছিলেন। মৌনোতা তার কাছে গিয়ে বসে।
‘গুড মর্নিং আম্মু’।
কাকুলি হেসে বলে
‘গুড মর্নিং। কফি খাবে না চা’?
‘না কিছু খাবো না। বাবা আসবে কবে’?
‘হুম আসবে। তুমি কিছু খাবে না। চলো সকালের নাস্তা খেয়েনেবে’।
কাকুলি উঠে যায়। কালাম চৌধুরীর কথা বলেই কথার প্রসঙ্গ পালটিয়ে দেয়। রোহান হিয়া দৌড়ে আসে।
‘নতুন ভাবি কি করো’?
মৌনোতা হেসে ওদের কপালে চুমু দেয়। মৌনোতার সাথে ওদের খুব ভাব। প্রতিদিন ওদের সাথে অনেক সময় কাটায়।
‘স্কুলে যাবে না’?
‘হুম যাবো তো। আম্মু আসুক। তুমি খাবার খেয়েছো’?
মৌনোতা মাথা নাড়ায়।
‘চলো এক সাথে খাই।
‘হুম চলো’।
‘কি খবর নাতবউ’?
বাচ্চু চৌধুরী এসে মৌনোতাকে বলে। মৌনোতা হেসে উতর দেয়
‘জী ভালো দাদু আপনার’?
‘খুন ভালো। আমার নাতি কই’?
‘একটা প্রোগ্রামে গেছে’।
সবাই এক সাথে সকালের নাস্তা খেতে থাকে। মৌনোতা কাকুলে বলে
‘আম্মু আরিয়া কই’?
‘ও তো কলেজ এ গেছে’।
‘এত সকালে’?
‘হুম বলল কি দরকারি এসাইনমেন্ট আছে তাই’।
‘ওর পা ঠিক হইছে’?
‘হুম আগের থেকে অনেক ভালো’।
মৌনোতা খেয়ে সাহেরা খাতুনের ঘরে যায়। একা একা ভালো লাগে না। আরিয়া থাকলে ভালো লাগে।
সাহেরা খাতুন শুয়ে ছিল। বুলবুলি পা টিপে দিচ্ছিলো।
‘কি করো দাদু’?
কারো কথার শব্দ পেয়ে চোখে খুলে সে।
‘কেরা’?
‘তুমার নাতবউ’।
বুলবুলি জোরে বলে। মৌনোতা মুচকি হেসে পাশে বসে।
‘বইরা! কে বইরা। তোর মনে হয় আমি বইরা’?
একটু রাগি কন্ঠে বলে সাহেরা খাতুন।
‘আহো নাতবউ’।
বুলবুলি কপাল চাপরে বলে
‘কি কই আর কি হুনে’!
মৌনোতা সাহেরা খাতুনের পাশে বসে
‘শরীর কেমন লাগে’?
‘হো ভাল। গিরুতে একটু ব্যাথা বারছে। খাইছছ’?
মৌনোতা মাথা নাড়ায়।
‘আপনি খেয়েছেন’?
‘হো খাইলাম’।
‘বুড়ি সারা দিনই খাই। তারপরেও এতো অসুখ হই কেমনা বুঝি না’।
মুখ বাকিয়ে বলে বুলবুলি। মৌনোতা মুচকি হাসে।
‘কি কইলিরে’?
‘কিছু না’।
‘তুমি খাইছো বুলবুলি’?
‘না’।
‘আচ্ছা যাও তুমি। আমি পা টিপে দিচ্ছি’।
‘আমার পুতিরা আইবো কবে নাতবউ’?
মৌনোতার হাত থেমে যায়। বোমা বিস্ফরণের মত চমকায়।। সাহেরা খাতুন আবারো বলতে শুরু করে
‘হুনো নাতবউ আমার কইলাম পুতি তারাতাড়ি চাই। কিবে আবার মইরা যাই ঠিক নাই। আমার নাতির ঘরের পুতিরে দেইখা মরবার চাই’।
মৌনোতার রগে রগে কাপুনি ধরে। কি সঅব। ওই ভিলেনটার এত কাছে ও যাবে। কখনই না।
মৌনোতার মুখ লাল হয়ে যেতে দেখে সাহেরা খাতুন জোরে হেসে উঠে।
‘এত লজ্জা পাওয়ার কি হইলো। জামাইয়ের লগে ওই সব করার সময় লজ্জা কন থাকে। আর আমি পুতি চাইছি দেইখা এত লজ্জা হায় হায়’।
না এখানে আর থাকা যাবে না। তাহলে ও লজ্জায় মরেই যাবে। মৌনোতা ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সাহেরা খাতুন ওর লজ্জা দেখে আবারো হেসে উঠে।
চলবে…
®তোয়ামনি